বুধবার, জুলাই ১৬, ২০২৫

স্মরণে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তাহলে বুদ্ধিজীবীরা জাতির বিবেক। বিজয়ের দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বুদ্ধিজীবীদেরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা এক রহস্যজনক অধ্যায়। পাক হানাদাররা যখন বিভিন্ন জেলা থেকে পালাতে বাধ্য, এক পর্যায়ে তারা তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে পিছু হাঁটতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই বিভিন্ন জেলাকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করতে থাকে মুক্তি বাহিনীরা। তারপর ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে হয় পুরো বাংলাদেশের বিজয়। কিন্তু তার দুই দিন আগেই ঘটে বুদ্ধিজীবী হত্যার ন্যক্কারজনক ঘটনা। তারা পরাজয় নিশ্চিত জেনে জাতিকে মেধাশূন্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করতেই এমন ঘটনা ঘটায় বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু তার গভীরে কি আরও কোনো কিন্তু আছে? হয়তবা।

জাতিকে মেধাশূন্য করার যে যুক্তি এটা কোনো ভাবেই ফেলে দেওয়ার নয়। একাত্তরে সেদিন আমরা বিজয় অর্জন করেছি ঠিক, তারপর পরবর্তীতে রাষ্ট্র যে বেহাত হয়নি তা কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। বলা যায় এটা পাকিস্তানিদের একটা চক্রান্তই ছিল। যেভাবে ব্রিটিশরা যাবার আগে ধর্মীয় দাঙ্গা ও এক পর্যায়ে দেশভাগ করে গিয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল আমরা যেন জাতি হিশেবে এগিয়ে যেতে না পারি। ব্রিটিশরা আসলেই সফল হয়েছে। পাকিস্তানিদেরও কি এরকম কোনো লক্ষ্য ছিল? হ্যাঁ, কিছুটা তো ছিলই, তা তো লক্ষ্যই করা যায়। তবে দায় কি শুধু পাকিস্তানিদের? এই ষড়যন্ত্রের ভিতরে কি কোনো অভ্যন্তরীণ চক্রান্ত কাজ করছিল? অভ্যন্তরীণ শক্তির মধ্যে রাজাকার, আল-বদর, আল শামস এসব বাহিনী তো ছিলই। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো দলও কি ছিল এই চক্রান্তে? এই প্রশ্নও জাগে।

বিশেষ করে দেখা গেল যেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের অধিকাংশেই ছিল সমাজতান্ত্রিক ধারণার। আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্র রাখা হলেও এটা শুধু নামেই থেকে গেছে। কাজে কিছুই নেই। সুতরাং ধারণা করা এসব বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে তখন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রাখতে পারতো। তাই কি কৌশলে তাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা সমাজতন্ত্রকে দুর্বল করা হয়েছে? বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে সমাজতান্ত্রিকদের মধ্যে এমন ধারণা কোনো ভাবেই হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম গুম হওয়া ব্যক্তি হলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান (১৯৭২)। তিনিও ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ধারণার। তাঁকে গুম করেছিল কারা? তাকে গুম করলে কাদের লাভ? ক্রসফায়ারের নামে নিহত করা হয় জাসদের সিরাজ সিকদারকে (১৯৭৫, ২ জানুয়ারি)। ইতিহাসে সিরাজ সিকদারকে দেখানো হলো ভিলেন হিশেবে। অথচ সিরাজ সিকদাররাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আসল নায়ক ছিলেন। এইগুলা কারা করেছিল?

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, “সিরাজের বোন শামীম সিকদার তার ভাইকে হত্যার জন্য শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের ১৭ বছর পর ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুন এই বিষয়ে আদালতে মামলা করা হয়। সেই মামলা এখনো বিচারাধীন।” আহমদ ছফা বলেছিলেন, “প্রতিটি রাষ্ট্র নিজস্ব প্রয়োজনে ইতিহাসকে বিকৃত করে।” একাত্তর পরবর্তী যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা মূলত এটাই করতে চেয়েছে।

২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী পাকবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। মূলত ২৫ মার্চ রাতেই অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালে খুঁজে-খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। তবে পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ হতে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। এবং ডিসেম্বরের ১০ তারিখ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। তারপর ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ।

বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মরণে ঢাকায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। তেমনি এক স্মৃতি চিহ্ন রয়েছে আমার শহর সিলেটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। এখানেই মূলত বুদ্ধিজীবী ডা. শামসুদ্দীন আহমদ, শ্যামল কান্তি লালা, কোরবান আলী সহ আরও নাম না জানা অনেককে ধরে এনে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। সকল শহীদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানাই।

Share post:

spot_imgspot_img