বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হলো টপ সয়েল বা পরিপক্ক মাটি। এটি মূলত মাটির ওপরের সেই পাতলা স্তর, যেখানে গড়ে ওঠে ফসলের প্রাণ। প্রকৃতির দীর্ঘ লালন-পালনের ফসল এই স্তরটি, যা কৃষিকাজের ভিত্তি স্থাপন করে। জৈব পদার্থ, খনিজ লবণ এবং অগণিত জীবন্ত জীবাণুর এক জটিল সমন্বয়ে গঠিত এই টপ সয়েল উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে, মাটির উর্বরতা বজায় রাখে এবং পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি ও চক্র মুনাফার লোভে এই অপরিহার্য প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের খেলায় মেতেছে। শুরু হয়েছে টপ সয়েল বিক্রি করার এক নীরব কিন্তু ভয়াবহ প্রক্রিয়া। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে খাদ্য উৎপাদন, কৃষকের আয় এবং পরিবেশের ভারসাম্যে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত যেখানে ইটভাটা বা অন্যান্য নির্মাণ কাজের জন্য মাটির প্রয়োজন, সেখানে টপ সয়েল অবাধে বিক্রি হচ্ছে। শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন দিয়ে ফসলি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি স্তরটিকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর কিছু কৃষক সামান্য অর্থের লোভে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। ট্রাকের পর ট্রাক ভর্তি করে সেই মাটি চলে যাচ্ছে ইটভাটায়, পুকুর ভরাটের কাজে অথবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে।
টপ সয়েল কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
টপ সয়েল বা মাটির উপরিভাগের প্রথম ৫-১৫ সেন্টিমিটার অংশে থাকে অধিকাংশ পুষ্টি, জৈব পদার্থ ও মাইক্রো-অর্গানিজম—যা ফসলের শিকড়ের বিকাশ এবং পুষ্টি গ্রহণের জন্য অপরিহার্য। এই স্তরটি একদিকে যেমন ফসল উৎপাদনের মূল কারিগর, তেমনি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষারও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
টপ সয়েল অপসারনের ফলে মাটির গঠন ভেঙে যায়। জৈব পদার্থের অভাব দেখা দেয়, যা মাটির পানি ধারণক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। এর ফলে একদিকে যেমন জমিতে সেচ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়ে, অন্যদিকে সামান্য খরায় ফসল শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহারেও বাধ্য হন কৃষকরা, যা পরিবেশের উপর আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ভয়ের কারণ কেন ?
শুধু ফসল উৎপাদনই নয়, টপ সয়েল ধ্বংসের কারণে জীববৈচিত্র্যও মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। টপ সয়েলের সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছে হাজারো মাইক্রো অর্গানিজম, কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদের বীজ। এতে করে পোকামাকড়, পাখি, উভচর প্রাণীসহ বহু জীবের স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। বিশেষ করে পোকা, কেঁচো ও ছত্রাক যারা মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে সাহায্য করে তারা বিলুপ্তির পথে। উর্বরতা কমে যাওয়ায় আগের মতো গাছপালা জন্মাতে পারছে না। এতে দেশীয় ও বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে পাখি ও প্রাণীদের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়ছে।
টপ সয়েল হারানোর কারণে খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। গাছ কমে যায়, ফলে ভেষজভোজী প্রাণীরা খাদ্য পায় না। এই প্রভাব পড়ে শিকারি প্রাণীদের উপরও। একে বলা হয় ‘ট্রফিক ক্যাসকেড’—যেখানে এক প্রজাতির ক্ষয় অন্যদেরও বিপন্ন করে তোলে।
‘ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ ২০২০’ শীর্ষক এসআরডিআই গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে ১ কোটি ১২৪ লাখ হেক্টর জমিতে মাঝারি থেকে অতি মারাত্মক মাত্রার ভূমি অবক্ষয় ঘটেছে। গবেষণাটি ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই আয়তন দেশের প্রায় ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ। ক্ষয়ে যাওয়া ভূমি ২০০০ সালের ১০ দশমিক ৭০ মিলিয়ন হেক্টর পূর্বানুমানের চেয়ে শূন্য দশমিক ৫৪ মিলিয়ন হেক্টর বেশি।
মাটি ক্ষয়ের প্রধান কারণসমূহ
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি বছর ৮০-১০০ টন হেক্টর হারে টপ সয়েল ক্ষয় হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ।
একই জমিতে অতিরিক্ত চাষাবাদ ও একই ফসলের পুনরাবৃত্তির কারণে মাটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং উর্বরতা হারায়। প্রতি বর্ষায় পাহাড়ি ঢল ও অপ্রতিরোধযোগ্য বন্যায় নদীভাঙনের কারণেও উর্বর মাটি হারিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন যেমন, মরুকরণ, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে জমির আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে এবং টপ সয়েল ভেঙে পড়ছে। এছাড়া অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের জন্য মাটির জৈব উপাদান ধ্বংস করে দিচ্ছে, ফলে মাটি শক্ত ও অনুজীববিহীন হয়ে উঠছে।
ক্ষয় রোধ না করলে কী হতে পারে?
টপ সয়েল বিক্রির তাৎক্ষণিক আর্থিক লাভ হয়তো কিছু ব্যক্তি বা চক্রকে আকৃষ্ট করছে, কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কৃষিখাতের জন্য এক অশনিসংকেত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাত্র এক ইঞ্চি টপ সয়েল তৈরি হতে প্রকৃতির শত শত বছর লেগে যায়। সেই মূল্যবান স্তরটি যখন ধ্বংস করা হয়, তখন জমি তার উর্বরতা হারায়। ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ কৃষিজমি উৎপাদনক্ষমতা হারাতে পারে। এর প্রভাব শুধু খাদ্যে ঘাটতিই নয়, বাড়বে দারিদ্র্য, অভিবাসন এবং জলবায়ু সংকট।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ড. রাশেদুল হাসান বলেন, “টপ সয়েল পুনর্গঠনে শতাব্দী লাগে, কিন্তু হারাতে সময় লাগে মাত্র কয়েক বছর। এই ক্ষয় বন্ধ না হলে কৃষির ভবিষ্যৎ গভীর অনিশ্চয়তায় পড়বে।”
সরকার এবং কৃষি বিভাগ এই বিষয়ে অবগত থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে এর কার্যকর প্রতিরোধে দুর্বলতা দেখা যায়। আইনের দুর্বল প্রয়োগ, নজরদারির অভাব এবং সচেতনতার অভাবে এই অবৈধ ব্যবসা দিন দিন বিস্তার লাভ করছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল অনেক সময় এর সাথে জড়িত থাকায় সাধারণ কৃষক প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। এই ভয়াবহ প্রবণতা এখনই রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে এর চরম মূল্য দিতে হবে। কৃষিজমি তার উর্বরতা হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়বে, খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে, এবং দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
সমাধানের পথ কী?
জৈব সার ও সবুজ সার ব্যবহার বাড়ানো: জৈব সার (কম্পোস্ট, গোবর, কেঁচো সার ইত্যাদি) ও সবুজ সার (যেমন ধৈঞ্চা গাছ) মাটির উর্বরতা বাড়ায়, টপ সয়েলকে সমৃদ্ধ করে এবং এর গঠন মজবুত রাখে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব ও সবুজ সার ব্যবহার করলে মাটিতে জীববৈচিত্র্য বজায় থাকে, উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও কীটের সংখ্যা বাড়ে, যা টেকসই উৎপাদনের জন্য দরকার।
মাটির বিশ্রাম নিশ্চিত করা ও রোটেশন পদ্ধতিতে চাষাবাদ : একই জমিতে এক ধরনের ফসল বারবার চাষ করলে মাটি একতরফা পুষ্টি হারায় এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাটিকে কিছু সময় পর পর বিশ্রাম দেওয়া (ফেলো করা) এবং একাধিক প্রকার ফসল পালাক্রমে চাষ (রোটেশন পদ্ধতি) করলে মাটির পুষ্টি চক্র পুনরুদ্ধার হয় এবং টপ সয়েল ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক হয়।
কভার ক্রপ ও মালচিং ব্যবহার করে মাটি সুরক্ষা : কভার ক্রপ মানে হলো এমন ফসল চাষ করা যা প্রধান ফসলের মধ্যবর্তী সময়ে মাটিকে ঢাকা দিয়ে রাখে—যেমন খেসারি বা ধৈঞ্চা। এটি মাটির ক্ষয়, আগাছা জন্ম ও আর্দ্রতা হ্রাস রোধ করে।
মালচিং অর্থ হলো মাটির উপর শুকনো ঘাস, খড়, পাতা বা প্লাস্টিকের আবরণ ব্যবহার করা, যা বৃষ্টির পানিতে টপ সয়েল ধুয়ে যাওয়া ঠেকায় এবং মাটির তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ : ড্রিপ সেচ, সেন্সর-ভিত্তিক মাটির আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ, জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষাবাদ ইত্যাদি স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি টপ সয়েল সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি কৃষকদের এসব প্রযুক্তি ব্যবহার ও টেকসই কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিলে তারা আরও দক্ষ ও পরিবেশবান্ধব চাষ করতে পারবেন।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সচেতনতামূলক কার্যক্রম : মাটি রক্ষা, টপ সয়েল সংরক্ষণ ও টেকসই কৃষি সম্পর্কে কৃষক ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে গণমাধ্যমে প্রচারণা, মাঠপর্যায়ে সভা-সেমিনার, কৃষি মেলা, স্কুল পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা এবং এনজিও ও স্থানীয় প্রশাসনের অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালানো দরকার। এতে জনসম্পৃক্ততা বাড়বে এবং নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ তৈরি হবে।
আইনের কঠোর প্রয়োগ: টপ সয়েল বিক্রি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং আইন অমান্যকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
নজরদারি বৃদ্ধি: কৃষি জমিগুলোতে নিয়মিত নজরদারি জোরদার করতে হবে, যাতে কেউ অবৈধভাবে মাটি উত্তোলন করতে না পারে।
কৃষকদের বিকল্প আয়ের উৎস: কৃষকদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি করতে হবে, যাতে তারা শুধুমাত্র জমির উর্বর মাটি বিক্রির উপর নির্ভরশীল না হন।
টপ সয়েলের ক্ষয় একটি নীরব দুর্যোগ, যা চোখে পড়ে না, কিন্তু প্রভাব ফেলে গভীরভাবে। তবে সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমেই আমরা আমাদের কৃষি জমি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা করতে পারি। টপ সয়েল বিক্রি বন্ধ করা শুধু একটি কৃষি সমস্যা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এখনই যদি মাটি রক্ষার পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাবো এক অনুর্বর ভবিষ্যৎ।