বুধবার, জুলাই ১৬, ২০২৫

শিক্ষা কি আসলেই শাস্তি?

আমরা যে শিক্ষা গ্রহণ করছি এটাকে কি একপ্রকার শাস্তি বলা যায়? হয়তবা। যদিও এটাকে সরাসরি খুব সহজে বা প্রকাশ্যে শাস্তি বলা না হলেও তার গভীরে অর্থ খোঁজতে গেলে কিন্তু একপ্রকার শাস্তির কথা অগ্রাহ্য করা যাবে না। হ্যাঁ, শিক্ষা এক প্রকার শাস্তিই বটে। তবে আমরা এটাকে সহজেই স্বীকার করবো না এটাও সত্যি। শিক্ষার শাস্তি হচ্ছে, মানুষকে খাঁটি মানুষ হিশেবে তৈরি করা। তাহলে কথা হচ্ছে শিক্ষা যদি শাস্তিই হয় তাহলে মানুষ কেন এটা বেছে নিবে? বেছে নিবে কারণ হচ্ছে প্রকৃত মানুষ হওয়ার তাড়নায়, সভ্যতার তাড়নায়। যারা প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করে না, তারা যেন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে না।

পৃথিবীতে মানুষের আকৃতিতে জন্ম নিলেই শুধু মানুষ নয়, মান ও হুশ এর সমন্বয়ে তাকে মানুষ হতে হয়। অর্থাৎ শিক্ষার প্রকৃত সঞ্জীবনী সুধা গ্রহণের মাধ্যমে তাকে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হয়। বলতে হয় এটাও শিক্ষার একটা দর্শন।

কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য কি এখন প্রকৃত মানুষ হওয়ার চেষ্টা? বা প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের যে উদ্দেশ্য সেই উদ্দেশ্যে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসি? বর্তমান পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায় উত্তর হবে, না। প্রথমত আমরা শিক্ষার প্রকৃত অর্থই জানি না, বুঝতে পারি না এবং শিক্ষার উদ্দেশ্যও ঠিক করতে পারি না। কেননা আমরা এখন শিক্ষা গ্রহণ করতে আসি, সমাজে একটা ব্যক্তিগত অবস্থান তৈরি করে নেওয়া, ক্যারিয়ার গঠন ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যবসায়ীক ব্যক্তি সার্থ কেন্দ্রিক লক্ষ্য নিয়ে।

আমাদের অভিভাবকেরা সন্তানদের বলেন, পড়াশোনা করে বড় মানুষ হতে হবে। এই বড় মানুষ হওয়া বলতে তারা বুঝেন চাকরি করা, অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া, সমাজে ভালো অবস্থান তৈরি করা, কে কত বড় চাকরি করতে পারলো, কে কত বেশি বেতনের চাকরি পেলো এইসব। তখন তাদের মধ্যে যে তাড়না প্রয়োগ করা হয় সেটা আর আনন্দদায়ক শিক্ষা থাকে না, আড়ালে এক প্রকার শাস্তিই প্রয়োগ করা হয়। অথচ কথা ছিল শিক্ষা হবে আনন্দদায়ক।

এখন একজন মানুষকে এসব কিছু অর্জন করতে হলে বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। আর তার জন্য প্রয়োজন হয় একটা একাডেমিক কারিকুলাম ও সিলেবাসের সীমারেখা। শিক্ষাটা যখন বাধ্যতামূলক হয় এবং তার যখন একটা সীমারেখা আরোপ করা থাকে তখনই সেটা হয়ে যায় এক প্রকার শাস্তি।

এইখানে শিক্ষার শাস্তিকে দুই ভাবে দেখা যায়। যখন আপনি প্রকৃত মানুষ হওয়ার তাড়না, জীবনের সঞ্জীবনীর উদ্দেশ্যে ও জানার আগ্রহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে যাবেন তখন সেই শাস্তি মধুর শাস্তি। এইখানে আপনি আপনার ইচ্ছে মতো শিক্ষার চালিকাশক্তি এগিয়ে নিতে পারবেন, মুক্তভাবে জ্ঞানের চর্চা করতে পারবেন। আর এখানে আপনার আগ্রহ ও কৌতূহল কাজ করবে বলে এটা হবে মধুর শাস্তি।

কিন্তু আপনাকে যখন কারিকুলাম ও সিলেবাসে আবদ্ধ করা হবে, উদ্দেশ্য থাকবে এটা-সেটা হওয়া, বাধ্যবাধকতা থাকবে তখন কিন্তু একপ্রকার পরিপূর্ণ শাস্তির মধ্যেই আসলে পড়ে যাবেন। আমরা বর্তমান সময়ে দেখছি যে কোমলমতি শিশুদের উপর কিভাবে শিক্ষার চাপ প্রয়োগ করে দেওয়া হচ্ছে। এখানে তাকে তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভার বহন করতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত বয়স হওয়ার আগেই তাকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এবং যেখানে তাকে তিনটি বই হলেই যথেষ্ট সেখানে তাকে আটটি/নয়টি বইয়ের চাপ ঘাড়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। অর্থাৎ শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই অঘোষিত শান্তির আরোপ করে দেওয়া হচ্ছে শিশুদেরকে।

তারপর শিক্ষার আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে জ্ঞান অর্জন। অর্থাৎ জানার চেষ্টা। আর মানুষের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য হলো সত্যে পৌঁছনো। যে সত্যের সাহায্যে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে সঠিকভাবে বুঝা যায় এবং সময়ের প্রয়োজনমতো সমাজের পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করা যায়। তবে একাডেমিক শিক্ষা ছাড়াও আধ্যাত্মিকতায়ও জ্ঞানের কার্যকরী উদাহরণ পৃথিবীতে বহু পাওয়া যায়। যদিও বিগত সময়ে বহু মনীষী আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ফলে সমাজ পরিবর্তনের ভূমিকা রেখে গেছেন। তবে ঐ যে প্রয়োজনমতো পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করতে হয়, এটাকে জানতে আবার একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই প্রয়োজনবোধ, তাড়নাই শিক্ষার বৃত্তি ও কাঠামো গঠন করে দেয়।

অনেক আধ্যাত্মিক মনীষীরা একাডেমিক শিক্ষা না নিলেও শিক্ষা নিয়েছেন ধ্যান, ধারণা ও প্রকৃতির নিকটবর্তী হয়ে নানাভাবে। আধ্যাত্মিকতায় জাগ্রত বোধশক্তি থেকে কাজ করতো। এই আধ্যাত্মিকতায় জ্ঞান লাভের কিছু প্রয়োজনবোধ কাজ করতো। আর এটাই শিক্ষা। এই শিক্ষাই তার আধ্যাত্মিকতায় জ্ঞান লাভের শাস্তি। বলা যায় মধুর শাস্তি। তা না হলে সে জ্ঞান লাভ করবে কিভাবে? তবে শিক্ষা হচ্ছে মুক্ত। এখানে বাধ্যতামূলক কোনো ধরাবাধা নেই।

কিন্তু কালের বিবর্তনে শিক্ষায় যতো আধুনিকতা আসছে শিক্ষায় ততই শাস্তির মাত্রা লক্ষ্যমান হচ্ছে ধীরে ধীরে। বিশেষ করে বলতে বুঝায় একাডেমিক শিক্ষার কথা। একাডেমিক শিক্ষার একটা পর্যায় হচ্ছে পরীক্ষা। পরীক্ষা বলে, তোমাকে পাশ করতে হলে এইগুলা পড়তে হবে, সেগুলা পড়তে হবে। সুতরাং পরীক্ষায় পাশ করার শর্তে একপ্রকার একাডেমিক শাস্তি আরোপ করে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। এবং একাডেমিক শিক্ষায় শাস্তির উন্নতি ও অবনতি নির্ণায়কও হচ্ছে পরীক্ষা। পরীক্ষা নির্ণয় করে দেয় পরবর্তী কি শাস্তি আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। অর্থাৎ পরীক্ষার ফলাফলের উপর পরবর্তী শিক্ষার যে প্রয়োগ নির্ণয় করে দেওয়া হচ্ছে, এটাই শিক্ষার শাস্তি।

আমাদের অভিভাবকেরা সন্তানদের বলেন, পড়াশোনা করে বড় মানুষ হতে হবে। এই বড় মানুষ হওয়া বলতে তারা বুঝেন চাকরি করা, অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া, সমাজে ভালো অবস্থান তৈরি করা, কে কত বড় চাকরি করতে পারলো, কে কত বেশি বেতনের চাকরি পেলো এইসব। তখন তাদের মধ্যে যে তাড়না প্রয়োগ করা হয় সেটা আর আনন্দদায়ক শিক্ষা থাকে না, আড়ালে এক প্রকার শাস্তিই প্রয়োগ করা হয়। অথচ কথা ছিল শিক্ষা হবে আনন্দদায়ক। দেখা যাচ্ছে আমরা বরং শিক্ষাকে শান্তি রূপেই কার্যকর করছি দিন দিন।

প্রচলিত এই শিক্ষার সবচেয়ে বড় শাস্তি হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে তোতা পাখি বানাচ্ছে। অথচ কথা ছিল মানুষকে সত্যিকারের মানুষ বানানোর জন্য হচ্ছে শিক্ষা। মানুষকে মানুষ বানানোর জন্য যে শিক্ষা এটা দার্শনিক অর্থে শিক্ষার শাস্তি। কিন্তু যখন থেকে কোনো কিছু হওয়ার মাধ্যম হিশেবে শিক্ষাকে কার্যকর করার জন্য জোর দেওয়া শুরু হয়েছে, শিক্ষায় প্রয়োগ করা হচ্ছে তখন থেকে সেটা বাস্তবিক অর্থেই শাস্তির অভ্যন্তরে পড়ে। সেটা হয়তো কেউ কেউ মেনে নিবেন, আবার কেউ কেউ নিছকই প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক যুক্তি দেখাতে পারেন।

যে শিক্ষায় কৌতূহল কাজ করেনা, চিন্তার দুয়ার প্রসার করেনা সেই শিক্ষা হয়ে যায় গাদার খাটুনি। আমাদের দেশের একাডেমিক শিক্ষার অবস্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন গাদার খাটুনিতে পরিনত হয়েছে। এর দায় যেমন শিক্ষা ব্যবস্থার তেমনি শিক্ষক ও অভিভাবকদের উপরেও বর্তায়।

Share post:

spot_imgspot_img