মঙ্গলবার, জুলাই ১৫, ২০২৫

গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সম্পর্ক

ধর্ম নিরপেক্ষতা ছাড়া কখনও গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারেনা এমনকি কল্পনাও করা যায় না। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান এক টকশোর আলোচনায় বলেছেন ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র হতে পারে না’, একদম তাই। গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির দুটি। এছাড়াও আরও দুটি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশ মূলত গণতন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন হয়েছে অর্থাৎ যেটাকে আমরা প্রজাতন্ত্রের বাংলাদেশ বলি। ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান মূলত ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘আমি ধর্ম নিরপেক্ষতার একটি চারা বাংলাদেশে রোপণ করেছি। এই চারা কেউ যদি ছিড়ে ফেলতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায় তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।’

সুতরাং গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি ধর্ম নিরপেক্ষতা না থাকে তাহলে দেশের সাংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে কথা বলার স্বাধীনতা, অধিকার আদায়ের স্বাধীনতা অনেকাংশেই থাকবে না, এমনকি থাকবেই না বলা চলে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্টতা যেকোনো ধর্মেরই হোক না কেন। এমতাবস্থায় দেশের গণতন্ত্রের কোনো মূল্য থাকবে না। কোনো দেশের মধ্যে যদি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় জনগুষ্টির লোকের বসবাস থাকে তাহলে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখতে হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি মেনে চলা উচিত। কেননা প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেই কতিপয় মৌলবাদের অবস্থান বিদ্যমান থাকে। তারা দেশকে অভ্যন্তরীণ দাঙ্গার তুঙ্গে রাখতে চায়। আর এই দাঙ্গা টিকিয়ে রাখতে ধর্মীয় দাঙ্গাই এইটার প্রধান যন্ত্র। এই কারণেই একটা গনতন্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি মেনে চলা অতীব জরুরি বিষয়। ঠিক সেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও ধর্ম নিরপেক্ষতা থাকতে হবে তেমনি ধর্ম নিরপেক্ষ সেবা দানের অঙ্গীকার থাকা চাই।

ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি রক্ষা ও বাস্তবায়ন শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ট ধর্মের জনগুষ্টির দায়িত্ব নয় বরং সেটা প্রত্যেক ধর্মেরই দায়িত্ব। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই যদি বলি এখানে যদি ধর্ম নিরপেক্ষতা না থাকে তাহলে বাংলাদেশ আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকবে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বা ধর্ম নিরপেক্ষতা না থাকলে শুধু সংখ্যালঘু ধর্মের উপর নির্যাতন হবে না, নির্যাতন হবে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের মধ্যে নিম্ন ও নিরীহ শ্রেনীর মানুষের উপরও। বাংলাদেশে যেহুতু সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান তাই হয়তবা মুসলমানরা বলতে পারেন যে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রয়োজন নেই। ইতিহাস থেকে বলা যায়, পাকিস্তান থাকা কালিনও তো মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্টই ছিল তখন কিন্তু শুধু হিন্দু বা অন্য ধর্মের উপর অত্যাচার হয়নি মুসলমানদের উপরও অত্যাচার হয়েছে। এমনকি তখন পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি ছিল তবুও আমরাই নির্যাতিত হয়েছি। কেননা তখন তাদের কাছে আমাদের কোনো গনতন্ত্র ছিল না, আমরা বাঙালিরা তাদের কাছে নিরীহ ছিলাম।

বাঙ্গালী মুসলমানদের আরেকটি কথা চিন্তা করতে বলব, আপনারা নিজেদেরকে ভারতীয় মুসলমান হিসাবে একবার চিন্তা করুন সেখানে কিন্তু মুসলমানরা সংখ্যালঘু। সেখানে মুসলমানদের উপর নির্যাতন হলে আমরা যেমন
মেনে নিতে পারি না ঠিক তেমনি আমাদের দেশের হিন্দু ও অন্যান্য জনগুষ্টির উপরও নির্যাতন আমরা হতে দিতে পারি না। কেননা মানবিক বিচারবোধ এটাই বলে।

তবে কথা হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে অনেকেই মনে করেন এটা ধর্মহীনতা বা নাস্তিকতা নীতি। কেননা বাংলাদেশের অভিধানে সেকুলারিজম শব্দটি যদিও ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থে ব্যবহৃত হয়; তবে অনেকেই এটাকে তথাপি ইউরোপের উদাহরণ টেনে এনে একে ধর্মহীন মতবাদ অর্থের ব্যবহারের সাথে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে এখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও নাস্তিকতা শব্দের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা ও নাস্তিকতা এই দুটির ইংরেজি শব্দও ভিন্ন। যেমন ধর্ম নিরপেক্ষতা শব্দের অর্থ (secularism) এবং নাস্তিক শব্দের অর্থ (atheism)।

বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বক্তব্যে তুলে ধরা হলো, “১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যদি কেউ বলে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ অতএব, রাষ্ট্রঘোষিত ধর্মরিপেক্ষ মতবাদ কখনোই ইসলামবিরোধী নয়। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়টি স্পষ্ট করে আরও বলেছেন, ‘ইউরোপীয়রা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যা বুঝায় তা আমি মানি না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।”

এছাড়াও শিক্ষক ও কলামিস্ট আহনাফ আবদুল কাদির এর মতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পরিভাষা। যা সর্বধর্মীয় সমতা, সর্বধর্মীয় সহাবস্থান, সর্বধর্মীয় মানুষের স্বাধীনতা এবং সর্বধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। সব ধর্মের মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ অবস্থানকে তুলে ধরে।’ সুতরাং ধর্ম নিরপেক্ষতা কখনই ধর্মহীনতা বা নাস্তিকতা হতে পারেনা। তাই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে এবং মৌলবাদকে দমন করতে হলে অবশ্যই ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বজায় রাখতে হবে। সুতরাং ধর্ম নিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র হতে পারেনা এই কথাটি রাজনৈতিক ও দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে; কোনো ধর্মকে আঘাত করার অর্থে নয়। ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি কারো ধর্ম পালনের ব্যাঘাত সৃষ্টির অর্থেও ব্যবহৃত হয় না। অর্থাৎ বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতিতে যার যার নিজস্ব ধর্ম পালনের কোনো বাধা নেই।

বাংলাদেশ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। হিসাব করতে হবে আমরা কোথায় থেকে মুক্ত হয়েছি, কোথায় থেকে গড়তে হয়েছে। কেন মুক্ত হতে হয়েছে। বাংলাদেশের আধুনিকতা ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত নতুন রাষ্ট্র হিসাবে অবশ্যই গণতন্ত্রের প্রয়োজন। আমরা যেখান থেকে মুক্ত হয়েছি বা ফিরে এসেছি আমরা কিন্তু আবার সেখানে ফিরে যেতে পারিনা। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ যদি নির্দিষ্ট ধর্মীয় রাষ্ট্রের উপর আরোপ করা হয় তাহলে কিন্তু বাংলাদেশ আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তো কোনো তফাৎ থাকবে না। তবে বলা যেতে পারে যে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধ তো ধর্মীয় কোনো ইস্যুতে হয়নি? এইটা ঠিক, আমি অস্বীকার করছি না। তবে ইস্যু থাকা না থাকাকে কিন্তু একেবারেই ফেলে দেওয়া যায়না না। তখন কিন্তু হিন্দু মুসলিম সহ সবাইকে ঐক্য হতে হয়েছিল। সুতরাং কাউকেই বঞ্চিত করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা ঠিক হবেনা। নির্দিষ্ট একটি ধর্মের উপর বৃত্তি করে রাষ্ট্র চললে স্বাভাবিক ভাবেই এখানে ‘কান টানলে মাথা আসে’ বলে একটা কথা আছে ঠিক সেভাবেই এখানে সাম্প্রদায়িকতা চলে আসবে। আবার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়, যেমন খেজুরের রস কিন্তু বাসী হয়ে গেলে নেশা জাতীয় হয়ে যায়। ঠিক তেমনি বহু ধর্মীয় বিদ্যমান রাষ্ট্রে পরিচালনায় ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি ধর্মকে অতিরিক্ত সুযোগ প্রধানের প্রক্কালে সেটা বাসী হয়ে নেশা জাতীয় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখন বাকিরা বঞ্চিত হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকে। এজন্য আপনাকে বেশি দূরে থেকে হবেনা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে খেয়াল করলেই প্রমাণ পাবেন। সুতরাং এজন্যই আহমদ ছফা বলেছেন, “মুসলমানরা ১০০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশেকে একটি সেকুলার বাংলাদেশ বানাতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশ নামে যা থাকবে তা মূলত পাকিস্তান।”

শেষে এটাই বলতে হয় আমরা পাকিস্তান হতে স্বাধীন হইনি আবার ভারতের অনুসারী হওয়ার জন্যেও স্বাধীন হইনি। গণতন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব মূল নীতিতে ধর্ম মত নির্বিশেষে একত্রে বসবাসের জন্য স্বাধীন হয়েছে।

Share post:

spot_imgspot_img