একসময় আহমদ ছফাকে শুধু নামেই চিনতাম, জানতাম না। মানে আহমদ ছফার তখন শুধু নামেই শুনেছি কিন্তু তাকে পড়া হয়নি কখনও। এখনো যে পুরোপুরি জানি তাও স্বীকার করছি না। পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া একজন লেখককে জানতে হলে একমাত্র লেখকের রেখে যাওয়া লেখা পড়েই জানতে হয়। লেখা পড়ে পুরোপুরি জানতে না পারলেও কিছুটা হলেও জানা যায়। আহমদ ছফাকে তো আর সরাসরি জানার বা সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি তাই তার রেখে যাওয়া কর্মের মাধ্যমেই তাকে জানতে হবে। এটাকে এক প্রকার দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই ধরতে পারেন। কেননা আহমদ ছফা যখন ইহলোক ত্যাগ করেন তখনও আমার জন্ম হয়নি।
ছফার মৃত্যু হয় ২০০১ সালের ২৮ জুলাই। তার বছর খানিক পরে জন্ম হয় আমার। সুতরাং সরাসরি ছফার সান্নিধ্য পাওয়ার কোনো আমার উপায় আমার ছিল না বা আগামীতেও নেই। ঐযে আগে বলেছিলাম ছফাকে শুধুমাত্র নামে চিনতাম সেটা হলো লোকমুখে মাত্র নাম শুনেছি সেই এটুকুই। মূলত ছফা কে? কি ছিলেন? তার কিছুই জানতাম না।
একটা সময় যখন সাহিত্যের প্রতি নিজের একটা উৎসাহ আসে তখন মূলত জানা আহমদ ছফা একজন সাহিত্যিক ছিলেন। তবুও তখন তাকে নিয়ে কিছুই জানা হয়নি। শুধুমাত্র নাম পরিচয় আর তার কর্ম সম্পর্কে সম্পর্কে ধারণা পাই। তাকে সাহিত্যিক পরিচয়ে চিনার অনেক পরে একদিন পরিচয় হয় তরুণ প্রাবন্ধিক মুস্তাফিজ সৈয়দ ভাইয়ের সাথে। অতঃপর এক প্রকার প্রাবন্ধিক মুস্তাফিজ সৈয়দ ভাইয়ের উৎসাহের মাধ্যমেই তখন থেকে আহমদ ছফাকে জানার চেষ্টা শুরু করি।
আহমদ ছফাকে জানতে গিয়ে প্রথমে আমি তার স্মৃতিচারণ মূলক বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’ গ্রন্থটি পাঠের মাধ্যমে শুরু করি। গ্রন্থটি পড়ার পর থেকে নিজের মধ্যে ছফাকে জানার আগ্রহ বিরাজ করতে থাকে। তারপর একে একে তার উপন্যাস ও প্রবন্ধের গ্রন্থ সমূহ পড়তে শুরু করি। তখন নিজের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে, কেন আমি আরও আগে ছফাকে পড়তে শুরু করিনি? ছফা যে এক তথ্য ভান্ডার। এ পর্যন্ত ছফার যতগুলা বই পড়েছি সবকটিতেই নতুন নতুন তথ্য খোঁজে পেয়ছি। খোঁজে পেয়েছি তার গভীর চিন্তাভাবনা, তার গবেষণা।
একজন লেখকের সাথে কথা বলার একটা চমৎকার মাধ্যম হচ্ছে তার বই পড়ার মাধ্যমে। আমি যখন ছফার বই পড়তে বসি মনে হয় যেন ছফা আমার সামনে বসে কথাগুলো বলছেন আর আমি মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করছি। এছাড়াও আহমদ ছফাকে জানতে গিয়ে সলিমুল্লাহ খান সাহেবের রচিত গ্রন্থ ‘আহমদ ছফা সঞ্জীবনী’ বইটি আমাকে আরও সাহায্য করেছে। সলিমুল্লাহ খান সাহেবের মতে বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনের পর একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামকে বাদ দিলে দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন আহমদ ছফা। এছাড়াও প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সহ আরও অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা।
আহমদ ছফা সম্পর্কে জানতে আরও যে একজন লেখকের লেখা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তিনি হলেন নুরুল আনোয়ার সাহেব। নুরুল আনোয়ার আহমদ ছফার ভাইপো (ভাইয়ের ছেলে)। একসময়ে আহমদ ছফার সঙ্গীও ছিলেন বটে। নুরুল আনোয়ার সাহেবের লেখালেখির মাধ্যমেও ছফাকে নিয়ে নতুন অনেক কিছুই জানার সুযোগ হয়।
এই যেমন সেদিন একটা তথ্য জানলাম উনার লেখায়, আহমদ ছফাকে তার সময়ে ছোট বড় সমবয়সী সবাই ছফা ভাই বলেই ডাকতে পছন্দ করতেন। এমনকি ছফার ভাইপো নুরুল আনোয়ার সাহেবের বন্ধুরাও ছফাকে ছফা বলেই ডাকতেন। আহমদ ছফাও এই ছফা ভাই ডাককেই উপভোগ করতেন। আসলেই আহমদ ছফার জন্য ছফা ভাই ডাকটাই একটা আত্মীকরণ। আমি নিজেও বর্তমানে আহমদ ছফাকে অন্যদের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে ছফা ভাই বলেই সম্মোধন করি। ছফা ভাই সম্পর্কে পড়তে-জানতে প্রাবন্ধিক মুস্তাফিজ সৈয়দের (যাকে আমি ভাই বলেই সম্মোধন করি) সাথে চা আড্ডার ক্ষণেও ছফাকে নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনার ক্ষণে উনার কাছ থেকেও ছফা সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারি।
সম্প্রতি আহমদ ছফাকে নিয়ে উনার একটি গ্রন্থ আসছে শুনে অনেক খুশী হয়েছি। গ্রন্থটি হাতে এলে আরও অনেক বেশি আনন্দিত হবো। উনার নিজ ধারণায় ছফাকে নিয়ে জানতে পারব বলে বিশ্বাস। আহমদ ছফার লেখা ও সাক্ষাৎকার গুলো পড়লে দেখা যাবে আহমদ ছফার চিন্তাজুড়ে আগামীর বাংলাদেশ, রাষ্ট্রচিন্তা।
কিভাবে দাঁড়াবে বাংলাদেশ, কিভাবে দাঁড়াবে বাংলার লেখক-শিল্পী সমাজ, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজকাঠামো নিয়ে বিভোর চিন্তা ছিল তার লেখা জুড়ে।
ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়েছে। ছফাকে যতটুকুই জানতে পেরেছি সেই থেকে বলব ছফা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীন বুদ্ধিজীবি। ছফা কাউকে তোয়াক্কা করে লিখতেন না। ছফাকে জানতে গিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি তাও হয়তো ভালোভাবে জানতে পারিনি। আর ছফাকে পুরোপুরি জানাও হয়তবা আমার পক্ষে সম্ভব হবেনা কখনও! তবে ছফাকে নিয়ে জানার ইচ্ছা দিন দিন আরও প্রবল হচ্ছে। কেননা ছফাকে জানা এতো সহজ নয়। তবুও ছফাকে জানতে চাই, জানাতে চাই। ছফাকে নিয়ে আরও কথা হবে অন্যদিন, আজ এতটুকুই থাক।
আমাদের আহমদ ছফা আছেন, আমাদের ছফা থাকবেন তার মূল্যবান শিল্পকর্ম ও তথ্যবহুল লেখালেখির ভেতর।