মঙ্গলবার, জুলাই ১৫, ২০২৫

সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার খাদ্য প্রকৌশলী

অনেকেরই স্বপ্ন থাকে প্রকৌশলী হবে। এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতেই বাধে বিপত্তি। কারণ শুধু প্রকৌশলের মাঝেই রয়েছে হরেক রকম ভাগ। যেমন- কৃষি প্রকৌশল, তড়িৎ প্রকৌশল, কম্পিউটার প্রকৌশল, পুরকৌশল, জৈব প্রকৌশলসহ আরো অনেক। এর মধ্যে কোন বিষয়ে পড়বেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়াই যেন সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়ে। সিদ্ধান্তহীনতার এই পর্যায়ে আশার আলো দেখাতে পারে খাদ্য প্রকৌশল। সম্ভাবনা ও সুযোগ দুদিকেই এখন এগিয়ে রয়েছে এটি।

খাদ্য প্রকৌশল নিয়ে কেন পড়বেন?

খাদ্যপ্রকৌশলকে ইংরেজিতে বলা হয় ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং। খাদ্য প্রকৌশল (Food Engineering) একটি বহুমুখী শাখা, যা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, নিরাপত্তা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করে।

কী খাচ্ছি, কেন খাচ্ছি, খাওয়ার পর কী হচ্ছে, কোন খাবার খেলে কী উপকার পাওয়া যাবে- এসব প্রশ্ন যাদের মনে ঘুরপাক খায় তাদের জন্যই এই ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং।

এটি খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি খাদ্যের সুষ্ঠু উৎপাদন এবং সরবরাহ প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন, বিশ্বব্যাপী চাহিদা, বহুমুখী কর্মক্ষেত্র, উদ্ভাবনী কাজের সুযোগ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সংরক্ষণে ভূমিকা, উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ, বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে অবদান ইত্যাদি নানা কারণেই খাদ্য প্রকৌশল নিয়ে পড়া গুরুত্বপূর্ণ।

কোথায় পড়বেন?

বাংলাদেশেই বেশ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এ বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে-

  • বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
  • খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
  • শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
  • মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
  • চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)
  • ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

এ বিষয়ে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং (BSc in Food Engineering) নামক ডিগ্রিতে স্নাতক সম্পন্ন করার সুযোগ রয়েছে।

এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এ এই বিষয়টি পড়ানো হয় ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি নামে।

কী কী পড়তে হবে?

‘খাদ্য প্রকৌশল’ এর নামেই আছে খাদ্য। তাই খাদ্যের গুণাগুণ, বৈচিত্র্য, পুষ্টিসহ অন্যান্য সবকিছু, এক কথায় ‘খাদ্যসম্ভার’ নিয়েই এর সমগ্র আলোচনা।

খাদ্যপ্রকৌশলী হতে গেলে পড়তে হয়– ফুড সাইন্স, ফানডামেন্টাল অফ ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফুড মাইক্রোবায়োলজি, ফুড ল অ্যান্ড সেফটি, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ডিসপোজাল, ফুড ক্যামিস্ট্রি, প্যাকেজিং, নিউট্রিশন, সুগার ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিট অপারেশন, ফ্যাটস এন্ড অয়েল, ফুড এনালাইসিস, ডেইরি ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড ফ্যাক্টরি এন্ড স্টোরেজ বিল্ডিং, ফ্রুট ভেজিটেবল টেকনোলজি, বেভারেজ টেকনোলজি, রেফ্রিজারেটর সিস্টেম, ফুড প্রিজারভেশন, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, সেনিটাশন এন্ড হাইজিন ইত্যাদি।

এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ডিগ্রী নিতে গেলে কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের বাকি চারটি ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন সাবজেক্ট বাধ্যতামূলক ভাবে পড়তে হয়। এরমধ্যে- Department of Farm power and mechinery তে technology, heat engine, thermodynamic, refrigeration system ইত্যাদি, Department of Irrigation and water Managment এ fluid mechanics, hydraulics এর মতো বিষয়গুলো, Department of computer Science and Mathematics এ computer science, computer application, mathematics (1, 2, 3) ইত্যাদি কোর্সসমূহ শিখানো হয়। এছাড়াও Department of farm structure বিভাগে survey, strength of materials, engineering cost and estimation সহ বিভিন্ন বিষয় এই ডিপার্টমেন্টের অধীনে পড়ানো হয়। তাছাড়া বিভিন্ন অনুষদের আরো কিছু কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে।

খাদ্য প্রকৌশলে পড়ার ভবিষ্যৎ কী?

ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর দেশে ও দেশের বাইরে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি অনেক চাকরির সুযোগ।

সরকারি চাকরির মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
১. বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথোরিটিতে সায়েন্টিফিক অফিসার, এডিশনাল অফিসার, স্যানিটারি এন্ড হাইজিন মেইনটেইনস অফিসার ইত্যাদি পদে চাকরির সুযোগ।
২. BARI-তে সায়েন্টিফিক অফিসার পদে চাকরির সুযোগ।
৩. বারটানে ফুড ইন্সট্রাক্টর বা প্রশিক্ষক হিসাবে চাকরি করার সুযোগ।
এছাড়া বিসিএসে আলাদা পোস্ট তৈরির জন্য প্রক্রিয়া চলছে এবং রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ।

বেসরকারি চাকরির মধ্যে-
১. বিভিন্ন ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিতে প্রোডাক্টশন অফিসার, কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার হিসাবে চাকরির সুযোগ। যেমন: ইগলু আইসক্রিম, পোলার আইসক্রিম, প্রাণ, এসিআই, আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ, নিউজিল্যান্ড ডেইরি সহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ রয়েছে।
২. ফুড রিলেটেড বিভিন্ন প্রোজেক্ট এ আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি করার সুযোগ রয়েছে। যেমন: নিউট্রিশন, ইন্টারন্যাশনাল প্রোজেক্ট।
৩. বিভিন্ন হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে নিউট্রিশিয়ান বা ডায়েটিশিয়ান হিসাবে কাজ করার সুযোগ।
৪. বিভিন্ন নামী দামী রেস্তোরাঁ বা রেস্টুরেন্ট এ কাজের সুযোগ।

এছাড়া বড় বড় ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার পাশাপাশি FAO, FDA, WHO, UNDP ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে পড়ে কী কী জানা যাবে?

একজন ব্যক্তি খাদ্য প্রকৌশলে পড়ে খাদ্যের গুণগত মান, পুষ্টিগুণ সম্পর্কিত তথ্য, পুষ্টির অভাব জনিত রোগ ও তার প্রতিকার, খাদ্য আমদানি রফতানি বিষয়ক তথ্যাদি, খাদ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, খাদ্যের অনুজীব, রসায়ন ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পারবে, যা শুধু নিজের কর্মক্ষেত্রেই নয় দৈনন্দিন জীবনেও কাজে লাগবে।

এছাড়া এই ডিগ্রিতে একটি ফুড ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে যা যা লাগে সে বিষয়ে সব জ্ঞান দেওয়া হয়। ইন্ডাস্ট্রির নকশা থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা, ইন্ড্রাস্ট্রির অবকাঠামো তৈরির জন্য সকল বিষয়াদি, যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করাসহ কম্পিউটারিং বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে দক্ষ ও পারদর্শীভাবে তৈরি করা হয়।

বর্তমান সময়ে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ। আধুনিক যুগের বিভিন্ন প্রযুক্তি ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে খাদ্যের সঠিক গুণাগুণ বজায় রাখা যায়, পুষ্টিমান নিশ্চিত করা যায়, পরিমিত খাদ্যের উপাদান বজায় রাখা যায়, সবার জন্য সুষম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা যায় এসব নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। এই সকল বিষয়ের জন্য ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বা ফুড টেকনোলজি পড়ার কোন বিকল্প নেই।

Share post:

spot_imgspot_img