একাত্তরের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফসল আমাদের বিজয়, লাল সবুজের বাংলাদেশ। তবে এই বিজয় সহজেই আসেনি। এই বিজয় এসেছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ হলেও শোষক পাকিস্তানের শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম ছিল দেশভাগের পর অর্থাৎ সাত চল্লিশের শুরু থেকেই। তারপর আন্দোলন-সংগ্রাম চূড়ান্তভাবে রূপ নেয় যুদ্ধের। অতঃপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ইতিহাস সকলেরই জানা। আর বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে। সুতরাং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র যতদিন আছে একাত্তরকে অস্বীকার করা যাবে না, একাত্তরের ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।
আওয়ামীলীগের গত ষোল বছরের পুঁজি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। তারা শেখ মুজিবের ক্ষতি করেছে, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধেরও ক্ষতি করেছে। একথা সত্য। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আওয়ামীলীগের কোনো নিজস্ব সম্পত্তি নয়। তবে এটা নিয়েও তারা পুঁজি করেছে।
সম্প্রতি চব্বিশের ছাত্র আন্দোল ও অভ্যুত্থানে দীর্ঘ ষোল বছরের আওয়ামীলীগের সৈরাচারী সরকারের পতনের পর থেকেই একাত্তর নিয়ে ষড়যন্ত্রের নানান ইঙ্গিত ও সুর উঠতে দেখা যায়। আওয়ামীলীগ এই ষোল বছর অপরাধ করেছে, তাই দেশের জনগণ এই অভ্যুত্থানে সরব হয়ে তাদের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছিল। তাদের অন্যায়ের বিচার হোক। কিন্তু একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ষড়যন্ত্রের লিপ্সা যারা দেখাচ্ছে এরা কারা? এরাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ শক্তি, অর্থাৎ রাজাকার ও তাদের অনুসারী। একাত্তরের পরাজয় তারা এখনো মেনে নিতে পারেনি। তাই সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে চায়। এরকম চেষ্টা আগেও হয়েছে। কিন্তু আওয়ামীলীগের পরাজয়েই তারা এই সুযোগ পায় কেন? লেখক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা বলেছেন, “আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনে জেতে তখন একাই জেতে। যখন হারে তখন গোটা বাংলাদেশ হারে।” অর্থাৎ আহমদ ছফা বলতে চেয়েছেন আওয়ামীলীগ যখন ক্ষমতায় তখন তাদের একারই জয়। আর যখন তারা ক্ষমতায় নেই তখন বাংলাদেশের পরাজয় হয় এই অর্থে যে, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তখন তৎপরতার সুযোগ পায়। আর একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যখন বিরোধী শক্তি তৎপর হয় সেটাই বাংলাদেশের হার। এটা অপ্রিয় সত্য। এমনকি এবারের আওয়ামীলীগের উৎখাতের মধ্যে দিয়েও সেটাই লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে যে বিজয় এসেছে বাংলাদেশের জন্ম হয়ে সে বিজয় হারতে পারে না। বাংলাদেশের যতক্ষণ বেঁচে থাকবে এই বিজয় লড়ে যাবে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে। আর নয়তো বাংলাদেশেই আর বেঁচে থাকবে না। তবে লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের মৃত্যু সহজেই হতে পারে না। সকল ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াবে দেশের জনগণ।
গত ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ‘আজকের পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লিখেছেন, “এটা অবিশ্বাস্য, লজ্জাজনক ও দুঃখজনক যে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে অপ্রত্যক্ষে জামায়াত কী করে এই রাষ্ট্রের শাসনে আসে? এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা ছিল, সেই অবস্থান তারা যে পরিত্যাগ করেছে, এমন কোনো ঘোষণা তারা দেয়নি। একাত্তর সালে তাদের ভূমিকার জন্য তারা জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। অথচ জামায়াত নেতারা অবলীলায় দেশবাসীকে জ্ঞান দিয়ে চলেছেন। বর্তমান সরকার এদের মেনে নিচ্ছে কোন যুক্তিতে? জামায়াত রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এ কারণেই তাদের একাত্তরের ভূমিকার কথা ভুলে যেতে হবে? ভুলে যেতে হবে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জামায়াতের প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার কথা? জনসমর্থনের দিক থেকেও জামায়াত একাত্তরে খুব এগিয়ে ছিল না, এখনো নেই। আমাদের জনগণ কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ, এই অর্থে যে তারা রাষ্ট্র ও ধর্মকে এক করে দেখে না।”
হ্যাঁ, বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্র ও ধর্মকে এক করে দেখেনা বলেই সেদিন তারা পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, যুদ্ধে যাপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানিরা ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদেরকে তাদের সঙ্গে রাখতে চেয়েছিল মূলত তাদেরই স্বার্থে। তারা একদিকে ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যদিকে ধর্মের লোকেদের উপরই শোষণ, নিপীড়ন করছে। তাই এখনো যারা এসব করছে তাদের ভাওতাবাজি জনগণ অবশ্যই বুঝে। তাই তাদের পাল্লায় পড়ে মানুষ একাত্তরকে ভুলে যাবে না।
‘একাত্তরকে ভুলতে পারে উন্মাদ ও বিকৃত মানুষ’ এই শিরোনামে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, “একাত্তরকে ভোলার তো প্রশ্নই ওঠে না। গণহত্যা এবং হানাদারদের অক্সিলারি ফোর্স আলবদর রাজাকার, জামায়াতে ইসলামীর অনাচার ভুলতে পারে উন্মাদ বা বিকৃত মনের মানুষ। স্মৃতিভ্রংশ মানুষ যেমন স্বাভাবিক মানুষ নয়, স্মৃতিভ্রংশ জাতিও তেমন স্বাভাবিক জাতি নয়। চাইলেই কি আমরা একাত্তরকে ভুলে যেতে পারব? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের বর্তমানের মধ্যে প্রবহমান রয়েছে। সে কারণে একাত্তরকে ভোলার প্রশ্নই ওঠে না।”
সিরাজুল ইসলামের কথাকেই বাস্তব ধরে নিতে হবে। কয়দিন আগে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়েও ষড়যন্ত্রের সুর উঠলো। হ্যাঁ, আওয়ামীলীগের গত ষোল বছরের পুঁজি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। তারা শেখ মুজিবের ক্ষতি করেছে, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধেরও ক্ষতি করেছে। একথা সত্য। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আওয়ামীলীগের কোনো নিজস্ব সম্পত্তি নয়। তবে এটা নিয়েও তারা পুঁজি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবাই কিন্তু আওয়ামীলীগ ছিল না। তখন সাধারণের কাছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট। তাই এটাকে এখন মানতে না পারলেও যারা লালন করে এসেছে তাদের মন থেকে কখনও মুছে ফেলা যাবে না। বরং আকড়ে ধরবে প্রবলভাবে।
যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ মানতে নারাজ, তারাই এখন চব্বিশ নিয়ে পুঁজি করছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিছুটা বেহাত হয়েছিল এটা সত্য। এরপরেও জনগণের সতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে আন্দোলন হয়েছে এদেশে। কিন্তু মানুষ একাত্তরকে ভুলে যায়নি। বরং মানুষ আকড়ে ধরেছে প্রবলভাবে। সুতরাং বিশ্ব মানচিত্রে যতদিন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র আছে অন্তত ততোদিন বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে একাত্তরের বিজয় ভুলানো যাবে না, ভুলানোরও নয়। কেননা এই বিজয় ছিল আমাদের অধিকার। যে বিজয়ে পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র ও একটি পতাকা।