বুধবার, জুলাই ১৬, ২০২৫

আলুর কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলা করবে কারাহ মডেল

বাংলাদেশের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল আলু। এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না, বরং দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। প্রতিবছর দেশে প্রায় ৫ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়, যা থেকে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়। তবে, নাবি ধসা বা মড়ক রোগের কারণে আলু চাষীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। প্রতিবছর প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় শুধুমাত্র এই রোগের কারণে।

এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ‘কারাহ মডেল’ নিয়ে একটি যুগান্তকারী গবেষণা চালানো হচ্ছে। চীন এবং বেলজিয়ামের উদ্ভাবিত এই মডেল মড়ক প্রতিরোধে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে আলু চাষকে আরও সাশ্রয়ী ও কার্যকর করতে পারে।

নাবি ধসা বা লেট ব্লাইট রোগ আলু চাষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)-এর তথ্যমতে, মড়ক রোগের কারণে প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত আলুর প্রায় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ে এবং অনেক সময় উৎপাদিত আলু বিক্রি করেও লাভ হয় না।

২০১৯ সালে অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম বেলজিয়ামের উদ্ভাবিত কারাহ মডেলের সঙ্গে পরিচিত হন। এটি মূলত একটি আবহাওয়া নির্ভর পূর্বাভাস পদ্ধতি, যা জমির তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের সঠিক সময় নির্ধারণ করে।

২০২৩ সালে অ্যাপেক্স এগ্রিসায়েন্স লিমিটেডের অর্থায়নে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে একটি কারাহ স্টেশন স্থাপন করা হয়। ‘এইচএসজেডি স্টেশন’ নামে পরিচিত এই আবহাওয়া স্টেশনটি জমির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকদের সতর্কবার্তা পাঠায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, কারাহ মডেলের মাধ্যমে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব। যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ১২ থেকে ১৬ বার ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়, সেখানে কারাহ মডেল ব্যবহার করে মাত্র ৬ বার প্রয়োগেই মড়ক প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ কমে গেছে এবং ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি ফলন পাওয়া গেছে।

অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক সময়ে সঠিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগের ফলে মড়ক রোগ শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এতে কৃষকের লাভের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।’

২০২৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড পটেটো কংগ্রেসে অধ্যাপক রসিদুল ইসলাম গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল উপস্থাপন করেন। তার গবেষণায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যেই, চায়না ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি (সিআইডিসিএ) বাংলাদেশে ১৮০টি আবহাওয়া স্টেশন স্থাপনের জন্য ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের প্রস্তাব বিবেচনা করছে।

গবেষকরা দেশের ১৫টি আলু উৎপাদনকারী জেলায় অন্তত ২ থেকে ৩টি করে আবহাওয়া স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং রাসায়নিক ছত্রাকনাশকের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে জৈবিক ছত্রাকনাশকের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

কারাহ মডেল শুধু আলু চাষে সীমাবদ্ধ থাকবে না। গবেষকরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে এটি ধান, গম এবং অন্যান্য ফসলেও সফলভাবে ব্যবহার করা যাবে। মডেলটির কার্যকারিতা নিয়ে অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য প্রযুক্তি-নির্ভর সমাধানের মাধ্যমে কৃষকদের ক্ষতি কমিয়ে আনা এবং কৃষিকে আরও টেকসই করা। কারাহ মডেল সেই লক্ষ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

বাংলাদেশের কৃষি খাতে কারাহ মডেলের মতো প্রযুক্তি নির্ভর সমাধান মড়ক রোগের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এটি শুধু উৎপাদন খরচ কমিয়ে লাভ বাড়াবে না, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

Share post:

spot_imgspot_img