সারাজীবন বিদ্রোহ, সংগ্রাম, সাম্যবাদ নিয়ে পড়ে থাকা নজরুলের জীবনেও প্রেম এসেছে, তাও একবার নয় বারবার। কখনও এসেছে ঝড়ের বেগে আবার কখনও বা এসেছে নীরবে, নিভৃতে। সময়ের পালা বদল করে করে এসেছে একেকবার একেক রূপে। ঝড়ের বেগে আসা প্রেম ঝড়ের বেগেই আঘাত হেনে চলে গেছে কোনো পাহাড়ের কোলে, আর নিভৃতে আসা প্রেম চলে গেছে নীরবেই লুকোচুরির মতো করে অন্তরালে।
বলছি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা, তাঁর প্রথম প্রেম ছিল ‘নার্গিস’। যার প্রকৃত নাম ছিল সৈয়দা আসার খানম, ‘নার্গিস’ নামটি ছিল নজরুলেরই দেওয়া ছদ্মনাম। ফরাসি দেশের ফুল নার্গিস ফুলের নাম থেকেই নজরুল সৈয়দাকে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন ‘নার্গিস’। ‘নার্গিস’ নজরুলের প্রকাশিত প্রথম প্রেম। প্রকাশিত বলেছি এই কারণে যে, এই মানুষটি মনে যে আগেও কোনো রমণীর জন্য প্রেম জাগেনি তার কি হয়াত্তা আছে বা তাঁকে যে কেউ মনে জায়গা দেয়নি তার কি হদিস আছে। হয়ত প্রকাশ ঘটেনি আগে। তবে তাঁর প্রথম প্রেম মিলনের কাছাকাছি গিয়েও পূর্ণতা পায়নি। কেননা নার্গিসের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বিয়ের রাত ফুরাবার আগেই নার্গিসকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন নজরুল। কমরেড মোজাফফর আহমদ সহ অনেকের মতে বিয়েটাই আসলে হয়নি। কেননা তার পিছনে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। তাই এটাকে বিয়ে মানতে নারাজ অনেকেই। পরে অবশ্য সেটা বুঝতে পেরেই চলে গিয়েছিলেন নজরুল।
কেন চলে গিয়েছিলেন নজরুল? নজরুলের চলে যাওয়ায় অবশ্য যথেষ্ট কারণ ছিল। তাহলে কি সেই কারণ? উত্তরটি দেওয়ার আগে বলা যাক নার্গিসের সাথে নজরুলের পরিচয় কিভাবে হয় সেদিকের কথায়। ‘নার্গিস’ অর্থাৎ সৈয়দা আসার খানম বর্তমান কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের খাঁ বাড়ির আসমাতুন্নেসার মেয়ে। তার পিতার নাম মুন্শী আবদুল খালেক। নার্গিসের মামা আলী আকবর খান নজরুলের সাথে কলকাতায় পাশাপাশি থাকতেন। তিনি নজরুলকে তার বাড়ি কুমিল্লায় নিয়ে যান ১৯২১ সালে। আর সেখান থেকেই নার্গিসের সাথে পরিচয়, তারপর নার্গিসের সাথে প্রেম হয় নজরুলের।
নার্গিসের মামা আলী আকবর তাদের প্রেমের কাহিনি মেনে নিয়ে প্রণয়ের আয়োজন শুরু করে। কিন্তু এত সহজেই মেনে নেওয়ার কারণ তো অবশ্যই ছিল। মূলত আলী আকবর আগে থেকেই চেয়েছিলেন নজরুলের সাথে তার বাড়ির কোনো মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া। নজরুল আর নার্গিসের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক যতটা সত্য ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল এই বিয়ের মধ্যে লোভ-লালসার ফন্দি, যা ছিল নার্গিসের মামা আলী আকবরের মধ্যে। সে চেয়েছিল নজরুলকে দিয়ে ছোটদের জন্য ছড়া-গল্প লিখিয়ে নিয়ে তা তার প্রকাশনা থেকে বই আকারে ছাপিয়ে ব্যবসা করে লাভ করবে। এখানে নজরুল যেন তার পরিকল্পনার ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’। অর্থাৎ নার্গিসের সাথে নজরুলের বিয়েটা ছিল এক প্রকার প্রতারণাও বটে। নজরুল সেই প্রতারণার বিষয়টি যখন বুঝতে পেরেছেন তখন কি তাঁর আর এখানে থাকা যায়? হয়তো মেরুদন্ড হীন হলে থাকা যায়, তবে নজরুলের তো মেরুদন্ড ছিল, নজরুল কেন থাকবেন। তাই নজরুল চলে গিয়েছিলেন সেদিন রাতেই। অবশ্য নজরুল যাওয়ার আগে নার্গিসকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। নার্গিস যেহেতু সঙ্গে যেতে রাজি ছিল না তাই নজরুলও আর বসে থাকেননি।
কিন্তু নার্গিস নামের যে ফুল, সৈয়দা আসার খানমের কি অপরাধ ছিল? তার মনে তো ছিল নজরুলের জন্য ফুলের মতোই সত্য প্রেম, নজরুলকে নিয়ে ঘর সংসারের বাসনা। কিন্তু সেই বাসনায় বেগ পেতে হয়েছে সৈয়দার নিজের মামা আলী আকবরের লোভের নিমিত্তেই। আর নজরুলের প্রেমকে হতে হয়েছিল চক্রান্তের শিকার। যেখানে নার্গিসের মামা আলী আকবর ফন্দি করেছিল বিয়ের পর নজরুলকে একেবারে নিজেদের বাড়িতে রেখে নজরুলকে দিয়ে বই লিখিয়ে তার প্রকাশনা ব্যবসা চালানোর ধান্দায়। যা ছোটখাটো কোনো চক্রান্ত নয়।
নার্গিস নজরুলের জন্য অপেক্ষা করেছিল অনেককাল। সে সময়টা আসলেই অনেককাল! নজরুল এই সময়ে কয়েকার কুমিল্লায় আসলেও নার্গিসের কাছে ফিরে যাননি আর। তবুও নার্গিস অপেক্ষায় ছিলেন তার বাবড়ি চুলওয়ালা প্রেমিক, স্বামী নজরুলের জন্য। নজরুলকে চিঠিও পাঠিয়েছেন নার্গিস। কিন্তু চিঠির কোনো প্রতিউত্তর আসেনি নজরুলের কাছ থেকে। এরমধ্যে অবশ্য নজরুল বিয়েও করে ফেলেছিলেন ‘আশালতা’কে।
নার্গিস অপেক্ষা করতে করতে যখন বুঝলেন নজরুল আর ফিরবেন না, তখন তিনি সিধান্ত নিলেন ঢাকায় গিয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করবেন। ঢাকায় চলে গেলেন মামা আলী আকবরের কাছে। ভর্তি হলেন একটি প্রতিষ্ঠানে। সেই প্রতিষ্ঠানেও তাকে তার পুরোনো জীবনের জন্য যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। যেমন একটা সময় সবাই জেনে গেল, সেই হচ্ছেন আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম স্ত্রী। তারপর নজরুল নার্গিসের বিয়ে, নজরুল কেন চলে গিয়েছিল এসব নিয়ে নানা মানুষের নানা কথাবার্তা, কৌতূহল সেখানেও তার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
অনেক অপেক্ষা-প্রতীক্ষার অবসান ঘটে একদিন। এরপর নজরুলের সাথে নার্গিসের দেখা হয়েছিল বটে, তাও প্রায় ১৬ বছর পরে। ততক্ষণে অবশ্য তাদের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তীকালে কবি আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয়। আর ঐদিকে এর আগেই নজরুলও সংসার পেতেছেন আশালতার সঙ্গে। কিন্তু নার্গিসের জীবন থেকে নজরুল চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেও, নার্গিসের মন থেকে কি নজরুল হারিয়ে যেতে পেরেছিল? খুব করে মনে হয় ‘না’। আর নজরুলের জীবন থেকে নার্গিস নামের ফুল ঝড়ে পড়ে ষড়যন্ত্রের লোভ লালসার শিকার হয়ে। যেখানে ফুলের অবশ্য কোনো দোষ ছিল না। তাও দুজনকেই মেনে নিতে হয়েছে একদিন। তবুও কি মেনে নেওয়া যায়? হয়তো না।