খাতা-কলমে পথ চলার শুরুটা ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে কোনো এক প্রিয় মানুষের জন্মদিন উপলক্ষে। এর আগেও তিনি মাঝে মধ্যে গাছ রোপণ করেছেন, তবে তখনও সেটা কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ ছিল না। জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি শাকিরের আলাদা একটা মায়া ছিল। যখন থেকে শাকির মনে করলেন যে, তিনি গাছ রোপণ করে যাবেন তখন শুরুটা ছিল ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে। ঐদিন গাছ রোপণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার গণনার যাত্রা। এর পর থেকে বছরের বিভিন্ন দিনে প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক, প্রিয় অভিনেতাদের জন্ম ও মৃত্যুদিবস স্মরণে এবং নিজের জন্মদিনকে কেন্দ্র করেও গাছ রোপণের অভিযান চলতে থাকে।
২০২০ সাল, তখন করোনাকালে হঠাৎ একদিন চিন্তা করলেন এভাবে শুধু দিবস কেন্দ্রিক থেকে বের হয়ে বছরের প্রতিদিন একটা করে হলেও গাছ রোপণ করবেন। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। শুরু করলেন যাত্রা। প্রতিদিন সময় না পেলেও সপ্তাহের অন্ততপক্ষে তিন থেকে চার দিন কিছুটা সময় কাটাতে থাকেন বৃক্ষ রোপণের সঙ্গে। দিনের কিছুটা সময় কাটান গাছের যত্নে। আর দিবস কেন্দ্রিক বৃক্ষ রোপণও চলছে পাশাপাশি। যেদিন গাছ রোপণ করেন সেদিন কয়টা রোপণ করেন তার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। কখনও দুই থেকে পনেরোটা এরকম করে চলতে থাকে তার এই যাত্রা। আনুষ্ঠানিকভাবে বৃক্ষ হাতে পথ চলার ১১ বছর পেরিয়ে গেছেন তিনি। এই সময়ে শাকিরের রোপণকৃত গাছের সংখ্যা (২৮ নভেম্বরের তথ্য মতে) ৩৩২৭৯টি।

এতোক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি হচ্ছেন সিলেটের শাহ সিকান্দার আহমদ শাকির। এখন তিনি বৃক্ষবন্ধু শাকির নামেই সবার কাছে বেশ পরিচিত। সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতিমধ্যে তার এই নাম ছড়িয়ে পড়েছে। বৃক্ষকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে চলা, বৃক্ষের যত্ন ও ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই মূলত তিনি হয়ে উঠেছেন বৃক্ষবন্ধু। সিলেট শহরের সড়কের বিভাজক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান— যেখানেই জায়গা পেয়েছেন গাছ রোপণ করেছেন, এখনো করছেন। এছাড়া শহরের বাইরে যেখানেই তার পদচারণ হয়েছে, সেখানেই চেষ্টা করেছেন একটি হলেও গাছ রোপণের। এভাবে সিলেট বিভাগের বাহিরেও আছে তার বৃক্ষ রোপণের পদচিহ্ন। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে যতগুলা গাছ আছে তার বেশিরভাগেই শাকিরের রোপণ করা।
তবে প্রথম দিকে এই পথচলার শুরুটা সহজ ছিল না শাকিরের। পেরিয়ে আসতে হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি, শুনতে হয়েছে মানুষের টিটকারি-মশকরা। এখনো মাঝে মধ্যে এরকম পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে তাকে। শুরুর দিকে একাই গাছ রোপণ করতেন। সাহায্যের জন্য তেমন কেউ ছিল না। বরং লোকে তাকে পাগল বলে খ্যাপাত ও নানান কিছু বলে নিরুৎসাহিত করতো। বন্ধুদের কাছেও হয়েছেন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার। গাছ রোপণ করতে গিয়ে অনেকের বাঁধার মুখেও পড়েছেন অনেকবার। যেখানে বাঁধা পেয়েছেন, সেখানেও চেষ্টা করেছেন লুকিয়ে হলেও গাছ রোপণের। আর যেখানে আগে থেকেই বুঝতে পেরেছেন বাঁধা আসবে সেখানে মোক্ষম সুযোগ বুঝে চুপিসারে গাছ রোপণ করে এসেছেন। এভাবেই নীরবে বৃক্ষবিপ্লব করে যাচ্ছেন এই তরুণ।
একটা সময় পর এ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতে না পারলেও দূর থেকে অনুপ্রেরণা দিতেন কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রথম আলো বন্ধুসভার সদ্য প্রয়াত বন্ধু হিমু পরিবহণের প্রতিষ্ঠাতা জুবায়ের কবির তুষার ও শিশুসাহিত্যিক দন্ত্যস রওশন। তারা সব সময় গাছ রোপণের খবরাখবর নিতেন। দিতেন উৎসাহ, অনুপ্ররেণা। এভাবে ধীরে ধীরে মানুষের কাছে ইতিবাচক সাড়া পেতে শুরু করেন শাকির।
তার গাছের সঙ্গে ছুটে চলার পাগলামি দেখে আগে যখন বেশির ভাগ লোক নেতিবাচক মন্তব্য করত, ধীরে ধীরে তাদের অনেকের কাছ থেকেই ইতিবাচক মন্তব্য আসতে শুরু করে। তাকে অনুসরণ করে তখন অনেকেই তার গাছ রোপণের সঙ্গী হতে শুরু করেন। এর মধ্যে মেহরাব, বিভাষ তালুকদার, দেবাশীষ রনি, মিসবাহ জামিল, উত্তম দাশ, নাসিম, মনোয়ার পারভেজ, স্বর্ণা ও আবদুল ওহাব অন্যতম। এভাবে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনকে সঙ্গে নিয়ে বৃক্ষরোপণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

শাকির গাছ রোপণ করেছেন, মানুষ উপড়ে ফেলে, নষ্ট করে দেয়। মন খারাপ হয়, তাও আবার রোপণ করেন। গাছ রোপণ করেই তার কাজ শেষ হয়ে যায় না; পানি দেওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণও করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা গাছ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায় ততক্ষণ।
শাকির মনে করেন, রোপণ করা প্রতিটি গাছ তার মনের খবর জানে। জানে তার দুঃখ-বেদনার গল্প। তাই কোনো কারণে-অকারণে মন খারাপ হলে তিনি গাছ রোপণ করেন, গাছের যত্ন-রক্ষণাবেক্ষণে সময় দেন। এতে মন ভালো হয়ে যায়।
শাকির ব্যক্তি উদ্যোগেই রোপণ করেন গাছ। তিনি বর্তমানে ন্যাশনাস হার্ট ফাউন্ডেশন, সিলেটের একাউন্ট শাখায় কর্মরত আছেন। চাকরির পাশাপাশি করেন দুতিনটি টিউশন। চাকরি ও টিউশনির প্রাপ্ত অর্থ থেকেই মূলত আসে তার গাছ কেনার টাকা। এতে অবশ্য তার পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই। বরং তার মা আরও উৎসাহ দেন ভালো কাছের প্রেরণায়।
তিনি গাছের সেবা ও যত্নে প্রকৃতিকে ভালো কিছু প্রদানের মাধ্যমে কাটিয়ে দিতে চান জীবনের বাকি দিনগুলো। প্রকৃতির কাছে তার যে ঋণ সেই কিছুটা হলেও শোধ করতে চান তার এই কাজের মাধ্যমে। রাখতে চান নিজের শহরকে সবুজায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন করে। এই প্রচেষ্টায় বৃক্ষ হাতে তার নিরন্তর ছুটে চলা।